বাংলাদেশে কিডনি রোগ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অনেক সময় এই রোগ কোনো লক্ষণ ছাড়াই কিডনি সম্পূর্ণ বিকল করে দেয়। তাই কিডনি সুস্থ রাখার উপায় সম্পর্কে জানা এবং সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এই প্রসঙ্গে একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যায়—সজীব নামে ২৬ বছরের এক তরুণের কথা। ফার্মেসিতে মাস্টার্স করে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করছিল সে। একদিন ক্লান্ত মুখে এসে জানাল, ‘স্যার, হাঁটলে হাঁপিয়ে যাই। খাবারে অরুচি, বমি বমি লাগে।’ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেল, তার রক্তচাপ অনেক বেশি, চেহারায় ফ্যাকাসে ভাব, রক্তশূন্যতা। চূড়ান্ত রিপোর্টে ধরা পড়ল, তার ৯৫ শতাংশ কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। অথচ কোনো লক্ষণ সে আগে বুঝতেই পারেনি। একটি নীরব ঘাতক ব্যাধি তার কিডনি ধ্বংস করে দিয়েছে।
কিডনি রোগের সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো হলো:
* অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস
* উচ্চ রক্তচাপ
* অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
* নেফ্রাইটিস
* অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
* ধূমপান
* দীর্ঘমেয়াদি ব্যথানাশক ওষুধ সেবন
* জন্মগত বা বংশগত কিডনি সমস্যা
* মূত্রনালী সংক্রমণ ও কিডনির পাথর
এসব কারণের বেশির ভাগই অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার ফল। সচেতন থাকলে অনেক কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সজীবের মতো কারো যদি জন্মগত কোনো সমস্যা থাকে, শিশুকালেই চিকিৎসা নিলে ভবিষ্যতে এমন পরিণতি এড়ানো যেত।
কিডনি রোগের লক্ষণ
কিডনি ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ বিকল না হলে বেশির ভাগ সময় রোগীর কিছুই বোঝা যায় না। তবে নিচের উপসর্গগুলো থাকলে সতর্ক হতে হবে:
* প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা রং পরিবর্তন
* চোখের নিচে বা পায়ে ফোলা
* অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা
* শ্বাসকষ্ট
* বমি বমি ভাব, অরুচি
* শরীরে চুলকানি
* রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাবে ফেনা বা রক্ত
* প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া
* পিঠ বা তলপেটে ব্যথা
শিশুদের ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি আছে কি না, তা নির্ণয় এবং চিকিৎসা জরুরি।
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন?
একবার কিডনি পুরোপুরি বিকল হলে চিকিৎসার একমাত্র উপায় হলো ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এসব চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে মাত্র ১০ শতাংশ রোগী এই ব্যয় বহন করতে পারেন। অথচ একটু সচেতনতা, নিয়মিত পরীক্ষা আর জীবনধারায় পরিবর্তন আনলে ৭০ শতাংশ কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কারা ঝুঁকিতে?
নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা কিডনি রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন:
* ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তরা
* ধূমপায়ী ও মাদকসেবীরা
* অতিরিক্ত ওজনের মানুষ
* যারা দীর্ঘদিন ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করেন
* যাদের পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস আছে
* যাদের কিডনিতে বারবার পাথর বা সংক্রমণ হয়
* যাদের বয়স ৪০ বছরের বেশি
কী পরীক্ষা করবেন?
বছরে মাত্র দুইটি পরীক্ষা করলে কিডনির সমস্যার প্রাথমিক অবস্থাতেই ধরা সম্ভব:
১। প্রস্রাবে প্রোটিন (অ্যালবুমিন) আছে কি না
২। রক্তে ক্রিয়েটিনিন মাত্রা, যা থেকে ইজিএফআর (eGFR) স্কোর পাওয়া যায়—এই স্কোর দেখায় কিডনি কতটা কাজ করছে।
কিডনি ভালো রাখার ৮টি উপায়
১। নিয়মিত ব্যায়াম করুন– দিনে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন হাঁটুন বা শরীরচর্চা করুন।
২। সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন– সবজি ও ফলমূল বেশি খান, চর্বি ও লবণ কম খান, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
৩। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন– রক্তে শর্করা ও HbA1c (সাতের নিচে) এবং প্রস্রাবে অ্যালবুমিন পরীক্ষা করুন।
৪। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বন্ধ করুন– চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না।
৫। ধূমপান ও মাদক ছাড়ুন– এগুলো কিডনির জন্য সরাসরি ক্ষতিকর।
৬। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন– টার্গেট হলো ১৩০/৮০–এর নিচে (আর অ্যালবুমিন থাকলে ১২০/৭০–এর নিচে)।
৭। নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করুন– উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে প্রতি ৬ মাসে কিডনি পরীক্ষা জরুরি।
৮। পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করুন– পানিশূন্যতা এড়াতে দিনে কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
সচেতন থাকুন, কিডনিকে বাঁচান
কিডনি রোগ শুধু ব্যক্তি নয়, পরিবার ও সমাজের ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। চিকিৎসা না করলে মৃত্যু অনিবার্য, আর চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে যান। অথচ সময়মতো সতর্কতা ও জীবনযাপনেই এই রোগের প্রতিরোধ সম্ভব। নিজে জানুন, অন্যকে জানান—তাহলেই গড়ে উঠবে সুস্থ, সচেতন একটি জাতি।
সুস্থ থাকুন, সচেতন থাকুন—কিডনিকে ভালো রাখুন।
আরও পড়ুন: খালি পেটে যে ৪ জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলবেন