অভ্যুত্থানের ছয় মাস: হতাশা, প্রত্যাশা ও অস্থির বাস্তবতা। বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের ছয় মাস পার হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সাধারণ মানুষের হতাশা বাড়িয়েছে। ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভে রিকশাচালক, দিনমজুর, শ্রমিক, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রবাসী, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রতিবাদ ছিল তীব্র। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য এবং সাবেক কর্মকর্তারাও জনগণের পক্ষে দাঁড়ান।
গোলাম নাফিজ ও এক রিকশাচালকের ত্যাগ
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় এক তরুণের মৃত্যু আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে। কলেজ ছাত্র গোলাম নাফিজ, যিনি রিকশার পাটাতনে বসে পতাকা বেঁধে প্রতিবাদ করছিলেন, পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন। এক রিকশাচালক, নূর মোহাম্মদ, তাকে জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে নিয়ে ছুটেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি নাফিজকে।
এখন, ছয় মাস পর, অবরোধ ও দাবির তোড়ে বিরক্ত নূর মোহাম্মদ হতাশ কণ্ঠে বলেন, “এতোদিন পাবলিক কই ছিল? মুখে তালা দেয়া ছিল? মূল কথাই কেউ বলে না, পাতিলে ভাত শেষ।” তার এই বক্তব্য আসলে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রতিচ্ছবি।
প্রবাসীদের প্রতিবাদ ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
দেশে যখন ইন্টারনেট শাটডাউন করে সহিংসতা চলছিল, তখন প্রবাসীরা চুপ করে বসে থাকেননি। তারা বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বিক্ষোভ করেছেন এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদি গণহত্যা বন্ধ না হয়, তাহলে তারা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করবেন।
জাপান পরবাস সম্পাদক কাজী ইনসানুল হক বলছেন, “দেশ যারা চালাচ্ছে, সেখানে ভালো-মন্দ লোক রয়েছে। কিন্তু তারা যে খুব ভালোভাবে দেশ চালাচ্ছে, এমনটা মনে হচ্ছে না।”
জাপানের ইউকোহামা ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার আব্দুল মালেক মনে করেন, “প্রশাসনিক ও আইন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে মানুষ দেশে আইনের শাসন পায়। প্রশাসন যেন দেশের জন্য কাজ করে, কোনো ব্যক্তি বা দলের জন্য নয়।”
সেনাবাহিনীর ভেতরের টানাপোড়েন
আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য সামনে এগিয়ে এসে জনতাকে রক্ষা করেছিলেন। কারফিউ উপেক্ষা করে সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও পথে নেমেছিলেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, “৩ আগস্ট যখন বর্তমান সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে তরুণ অফিসাররা জিজ্ঞেস করলেন, কাকে গুলি করবো? আমাদের ভাইরাই তো ওইদিকে দাঁড়িয়ে আছে, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে গুলি করবে না। সেনাবাহিনী জনগণের পাশে থাকবে। সাবেক সেনা সদস্যদের মিছিল পুরো দেশকে একটি শক্তি দিয়েছে।”
তবে তিনি মনে করেন, নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনও দুর্বল, “পুলিশের কাজ পুলিশকেই করতে হবে, সেনাবাহিনীর কাজ সেনাবাহিনীর করতে হবে। কাউকে কারও দায়িত্ব পালন করা উচিত নয়। এখনও ষড়যন্ত্র চলছে, শক্ত হাতে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”
রাজনীতির নতুন বাস্তবতা
অভ্যুত্থানের পর, শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্যাতনের শিকার হওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন সক্রিয়। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকীর মতে, “অভ্যুত্থানের পরবর্তী কাজগুলো অনেক ধীরগতিতে চলছে। সাবেক সরকারের দোসররা এখনও বিভিন্ন জায়গায় রয়ে গেছে এবং অকার্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও ঘাটতি আছে।”
জামায়াতে ইসলামী মনে করে, এখনও সুসংগঠিত ঐক্য গড়ে ওঠেনি। দলের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি, আমাদের বক্তব্য পৌঁছে যাচ্ছে। এতে আমাদেরও রাজনৈতিকভাবে লাভ হচ্ছে।”
বিএনপি বলছে, আগে দরকার জনগণের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। অযথা বিলম্ব হলে জনগণ প্রতিবাদ করবেই।”
জনতার অগ্রাধিকার: নিরাপত্তা ও দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ
ছয় মাসের অভ্যুত্থানের পর, দেশের সাধারণ মানুষের মূল দাবি দুটি—নিরাপত্তা এবং বাজার স্থিতিশীল করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো ছাড়া মানুষের জীবনে স্বস্তি আসবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে? নাকি হতাশা আরও গভীর হবে?
আরও পড়ুন:সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীকে সর্বদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার