২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার পিলখানা তৎকালীন বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) সদর দপ্তরে ঘটে যায় এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বিদ্রোহে প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন। এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ওপর চালানো সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ হিসেবে বিবেচিত।
২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল জয়লাভ করে। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার শপথ নেয় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। কিন্তু ক্ষমতায় আসার দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে পিলখানার এই মর্মান্তিক ঘটনা।
বিদ্রোহের সময় শেখ হাসিনা সরকার একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে নিরাপত্তাহীন বোধ করেন এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনীর সমর্থনে পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় তিনি ভারতের কাছ থেকে সহায়তা চান, যা প্রায়ই ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের মতো এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
ভারতের ভূমিকা
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ শুরু হলে ভারত বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ভারতের তৎকালীন ঢাকা মিশনের হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, শেখ হাসিনার অনুরোধে ভারত প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। তিনি বলেন, “আমরা কিছু সেনাকে সতর্ক রেখেছিলাম এবং হাসিনাকে জানিয়েছিলাম যে আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।”
ভারতের কূটনৈতিক বিশ্লেষক অভিনাশ পালিওয়াল তার বই **”India’s Near East: A New History”**-এ উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনা ওই সময়ে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের প্রণব মুখার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মুখার্জি তাকে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিবশংকর মেননও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
সামরিক প্রস্তুতি
বিদ্রোহের দ্বিতীয় দিন, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৬ষ্ঠ প্যারাট্রুপার রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন বাংলাদেশে অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের কালাইকুণ্ডা বিমানঘাঁটিতে ১,০০০ প্যারাট্রুপার মোতায়েন করা হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও তেজগাঁও বিমানবন্দর দখল এবং শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উদ্দিন আহমেদকে সতর্ক করে জানানো হয়, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়, তবে ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা এক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় প্রবেশ করবে।
সংকটের রাজনৈতিক সমাধান
শেষ পর্যন্ত, সংকটটি সামরিক নয়, রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়।
বিদ্রোহের পর বিডিআর বাহিনী বিলুপ্ত করে নতুন নামকরণ করা হয় **বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)**। ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা শেষ পর্যন্ত না হলেও, এই ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি জটিল অধ্যায় হিসেবে থেকে যায়।
২০০৯ সালের এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে শুধু একটি সামরিক সংকটই নয়, দেশের নিরাপত্তা, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার এক কঠিন পরীক্ষা ছিল।